রূপচর্চায় প্রাচীন যুগ থেকে মুলতানি মাটি

ত্বকের যত্নের জন্য মানুষে কত কিছুই না করে, পুকুরে গোসল করার সময় কাদা দিয়েই বউ-ঝিরা পরিষ্কার করে ফেলতেন হাত-পা। দামি ক্রিম, ক্লেনজার, স্ক্রাব নয়, যুগ যুগ ধরে এভাবেই তাঁরা যত্ন নিয়ে আসছেন ত্বকের। এ সময়ের সৌন্দর্যচর্চাতেও ব্যবহার হতে পারে মাটির। আয়ুর্বেদ ও রূপবিশেষজ্ঞ রাহিমা সুলতানা বলেন, “পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রূপচচর্চায় মাটির ব্যবহার দেখা যায়। তবে এখন স্পার ক্ষেত্রে মাটি বেশি ব্যবহূত হয়। স্পাতে একে বলা হয় মাড থেরাপি, মাটিতে যেসব খনিজ উপাদান রয়েছে, তা আমাদের ত্বকের জন্য ভালো ক্লেনজারের ভূমিকা পালনের পাশাপাশি ময়েশ্চরাইজারের কাজও করে”।  সৌন্দর্যচর্চায় বিভিন্ন ধরনের মাটির ব্যবহার হয়। একেক ধরনের মাটির কাজ একেক রকম। রাহিমা সুলতানা জানান, লাল, সাদা, ধূসর, সবুজ—এ চার ধরনের মাটি ব্যবহূত হয় রূপচর্চায়। এর মধ্যে কোনো কোনোটি নির্দিষ্ট নামে পরিচিত, আবার কোনো কোনোটি রং দ্বারা পরিচিত।

 

ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়াতে মুলতানি মাটির জুড়ি নেই। আমাদের দেশে প্রসাধনীর দোকানে এ মাটি কিনতে পাওয়া যায়। এর বিকল্প হিসেবে আমাদের দেশের লাল আঠালো এঁটেল মাটিও ব্যবহার করা যেতে পারে। ময়মনসিংহ, কুমিল্লা ও নরসিংদীর পাহাড়ি ও টিলা অঞ্চলে এ মাটি পেতে পারেন। এই মাটির সঙ্গে গোলাপজল মিশিয়ে মুখে লাগাতে পারেন। ২০ মিনিট রেখে পানি নিয়ে ধুয়ে নিন। এতে ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়বে। ত্বকের মরা কোষ ও ছোপ ছোপ কালো দাগ দূর করতে সবুজ মাটি ব্যবহার করতে পারেন। এটি স্ক্রাবের কাজ দেবে। স্পাতেও এ মাটি ব্যবহার করা হয়। গোসলের আগে পুরো গায়ে এ মাটি নিয়ে হালকাভাবে মালিশ করে নিন। এর সঙ্গে কয়েক ফোঁটা জলপাই তেল মিশিয়ে নিলে আরও ভালো কাজে দেবে। তবে এ মাটি এভাবে মুখমণ্ডলে ব্যবহার না করাই বোধকরি ভাল হবে।

ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়াতে মুলতানি মাটির জুড়ি নেই। রূপচর্চার জগতে মুলতানি মাটি একটি অতি পরিচিত নাম। সুদূর অতীত থেকে আজ পর্যন্ত রূপচর্চার উপকরণ হিসেবে মুলতানি মাটির অবদান বাড়ে বই কমেনি! পরিষ্কারক হিসেবেই মুলতানি মাটির ব্যবহার করা হয়, সেটা ত্বকও হতে পারে, আবার চুলও হতে পারে। যে-কোনও ধরনের ত্বকই হোক না কেন (শুষ্ক, তৈলাক্ত , মিশ্র ও স্বাভাবিক), সব ক্ষেত্রেই মুলতানি মাটি প্যাক হিসেবে ব্যবহারযোগ্য। যাদের ত্বক শুষ্ক তারা মুলতানি মাটির সঙ্গে আমন্ড বাদাম বাটা ও দুধ মিশিয়ে মুখে লাগাবে। তৈলাক্ত ত্বক হলে মুলতানি মাটির সঙ্গে গোলাপ জল মিশিয়ে লাগাতে পার।

 

ব্রণর জন্যঃ-  মুলতানি মাটির সঙ্গে টোম্যাটোর রস, হলুদ এবং চন্দনের গুঁড়ো মিশিয়ে প্যাক তৈরি করে মুখে লাগাতে হবে। দশ মিনিট পর ধুয়ে ফেলতে হবে। এই প্যাক সপ্তাহে দু’দিন লাগালে ব্রণ কমে যাবে।

 

ব্রণর দাগ ওঠাতেঃ-  অনেক সময় ব্রণ শুকিয়ে গেলেও, ব্রণর কালো দাগ মুখকে বিশ্রী করে তোলে। সেখানেও মুশকিলআসান মুলতানি মাটি। মুলতানি মাটির সঙ্গে নিমপাতা বাটা, লবঙ্গ, এক চিমটে কর্পূর এবং গোলাপজল মিশিয়ে প্রলেপ তৈরি করে লাগাতে হবে।

 

এ তো গেল মুখের কথা। বডিওয়াশ হিসেবেও দিব্যি কাজ করে এই আশ্চর্য মাটি। এক কাপ ওটমিল ও তার সঙ্গে নিমপাতা বাটা, হলুদ, চন্দনের গুঁড়ো, ছানা পাউডার (এক চা-চামচ), দুধ ও মুলতানি মাটি মিশিয়ে প্যাক তৈরি করে সারা গায়ে মাখতে হবে স্নানের আগে। তারপর ধুয়ে ফেলতে হবে। ব্যস, তুমি সঙ্গে-সঙ্গে পেয়ে যাবে ঝকঝকে ত্বক।

স্নানের আগে চুলেও মুলতানি মাটি লাগিয়ে স্নানের সময় ধুয়ে ফেলতে পার। এতে শুষ্ক চুলে আর্দ্রতা আসবে। চুলে স্বাভাবিক কন্ডিশনার ও ময়শ্চারাইজ়ার হিসেবে কাজ করে মুলতানি মাটি। চুলের ডগা যদি বেশি মাত্রায় ফাটে বা চুল পড়ার সমস্যা থাকে, তবে আগের দিন রাতে হট অয়েল মাসাজ করে পরদিন মুলতানি মাটির সঙ্গে টক দই মিশিয়ে মাথায় লাগাবে। প্যাক শুকিয়ে গেলে ঠান্ডা জলে ধুয়ে ফেলবে এবং পরের দিন শ্যাম্পু করবে।

 

প্রথমতঃ– তৈলাক্ত ত্বকের জন্য একটি ডিমের সাদা অংশ ফেটিয়ে নিন। এর সঙ্গে চার চা চামচ মুলতানি মাটি ও এক চা চামচ লেবুর রস মেশান। মিশ্রণটি মুখে, গলায় ও হাতে মেখে ১৫ মিনিট অপেক্ষা করুন। এরপর খুব ভালো করে ধুয়ে ফেলুন। এই মিশ্রণটি ত্বকের অতিরিক্ত তেল দূর করে আপনার ত্বককে করে তুলবে প্রাণবন্ত। মিশ্রণটি পুরো শরীরেও লাগাতে পারেন।

দ্বিতীয়তঃ– মুলতানি মাটি স্ক্রাবিংয়ের উপকরণ হিসেবেও খুবই কার্যকর! এক টেবিল চামচ মসুর ডালের গুঁড়া, তিন টেবিল চামচ মুলতানি মাটি, এক টেবিল চামচ লেবুর রস ও প্রয়োজনমতো শশার রস অথবা পানি ভালোভাবে মেশান। মিশ্রণটি পুরো শরীরে লাগিয়ে ১৫-২০ মিনিট হালকা মাসাজ করুন। এরপর ভালোভাবে গোসল করে ফেলুন। আপনার ত্বক হবে পরিষ্কার ও উজ্জ্বল।

তৃতীয়তঃ– ত্বকের রোদে পোড়া ও অনুজ্জ্বল ভাব দূর করতে মুলতানি মাটি ও শশার রস দিয়ে মিশ্রণ তৈরি করুন। প্রতিদিন বাইরে থেকে ফিরে মিশ্রণটি যেসব জায়গা বেরিয়ে ছিল সেসব জায়গার ত্বকে লাগান। ২০ মিনিট পর ধুয়ে ফেলুন। এতে আপনার ত্বকে সজীবতাও ফিরে আসবে।

চতুর্থঃ– ত্বকের অতিরিক্ত শুষ্কভাব কাটাতে মুলতানি মাটি, অলিভ অয়েল ও গোলাপজল মিশিয়ে পেস্ট তৈরি করুন। মিশ্রণটি ত্বকে লাগিয়ে ১৫-২০ মিনিট অপেক্ষা করুন। এরপর ভালোভাবে ধুয়ে ফেলুন। ত্বকের শুষ্কতা ও খসখসে ভাব কমাতে এই মিশ্রণটির জুড়ি নেই!

পঞ্চমঃ– ত্বকের হারানো সজীবতা ফিরে পেতে মুলতানি মাটি, অ্যালোভেরার রস ও গোলাপজল একসাথে মিশিয়ে ত্বকে লাগান। ২০ মিনিট পর ধুয়ে ফেলুন। প্রতিদিন মিশ্রণটি তৈরি করে ব্যবহার করুন। এতে আপনার ত্বকের মলিনতা দূর হয়ে ত্বক হয়ে উঠবে সজীব ও সুন্দর।

ষষ্ঠঃ– ব্রণের দাগ দূর করতে পরিমাণ মত মুলতানি মাটি, টমেটোর রস, কাঁচা হলুদ এবং স্যানডালউড পাউডার মিশিয়ে প্যাক তৈরি করুন। এটি মুখে লাগিয়ে ১০-১৫ মিনিট রেখে মুখ ধুয়ে ফেলুন। এই প্যাকটি খুব ভালো ক্লিনজার হিসেবেও কাজ করে। সপ্তাহে ২-৩ দিন এটি ব্যবহার করুন। ধীরে ধীরে মুখের দাগ দূর হয়ে ত্বক উজ্জ্বল এবং সুন্দর হবে।

সপ্তমঃ– ত্বককে বার্ধক্যের ছাপ থেকে রক্ষা করতে এক চা চামচ মুলতানি মাটির সাথে এক চা চামচ টক দই এবং একটি ডিমের সাদা অংশ মিশিয়ে প্যাক তৈরি করুন। এবার এটি সারা মুখে ভালো মত লাগিয়ে ২০ মিনিট রেখে মুখ ধুয়ে ফেলুন। এই প্যাকটি ত্বক টানটান করে এবং স্কিন টোন সমান করতে সাহায্য করে।

অষ্টমঃ–  ব্রণের সমস্যা যদি খুব বেশি হয়ে থাকে তাহলে কিছু নিম পাতা বেটে মুলতানি মাটির সাথে মিশিয়ে পেস্ট তৈরি করে মুখে লাগান। ১০-১৫ মিনিট রেখে মুখ ধুয়ে ফেলুন। নিয়মিত ব্যবহারে ব্রণের সমস্যা কমে যাবে।

নবমঃ-  অনেকেরই একটা কমন সমস্যা হল যে হাত পায়ের রঙ মুখের রঙ থেকে কালো হয়। এই সমস্যা সমাধানে পরিমাণ মত মুলতানি মাটি, বেসন এবং কাঁচা হলুদ বাটা মিশিয়ে প্যাক তৈরি করুন। এবার এই মিশ্রণটি হাত পায়ে ভালো মত লাগিয়ে ২০-৩০ মিনিট বা শুকানো পর্যন্ত অপেক্ষা করুন এবং এরপর হালকা গরম পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। প্রতিদিন গোসলের আগে এটি ব্যবহার করতে পারেন। এটি হাত পায়ের ত্বক উজ্জ্বল এবং নরম করে।

তাই, যুগের পর যুগ থেকে রূপচর্চার অনুসঙ্গ হিসেবে মুলতানি মাটি হয়ে আছে অনন্য।

 মুলতানি মাটির সহজ প্যাক

মুলতানি মাটি ও ডিম- ত্বকের ক্নান্ত ভাব দূর করে উজ্জ্বল ভাব আনতে এই প্যাক খুব উপকারী। দুই চা চামচ মুলতানি মাটি, এক চা চামচ দই, একটা ডিমের সাদা অংশ ও এক টেবিল চামচ কর্নফ্লাওয়ার এক সঙ্গে মিশিয়ে পেস্ট তৈরি করে নিন। মুখ ও গলায় দুই স্তরে এই প্যাক লাগান। সম্পূর্ণ শুকিয়ে গেলে ঠান্ডা জলে মুখ ধুয়ে নিন। মুলতানি মাটি ত্বক ভিতর থেকে পরিষ্কার করে, অন্যদিকে কর্নফ্লাওয়ার কালো ভাব দূর করে। দই শুষ্ক ভাব দূর করতে সাহায্য করে।

মুলতানি মাটি, শশা, রোজ ওয়াটার- পাঁচ-ছয়টা শশা খোসা ছাড়িয়ে রস বের করে নিন। এর সঙ্গে দুই চা চামচ মুলতানি মাটি ও ওক চা চামচ রোজ ওয়াটার মিশিয়ে পেস্ট তৈরি করে মুখ ও গলায় লাগিয়ে ১৫ মিনিট রাখুন। শুকিয়ে গেলে জল দিয়ে ধুয়ে নিন। শশা ত্বকের ট্যান দূর করে। রোজ ওয়াটার এক্সট্রা গ্লো নিয়ে আসে চেহারায়।

মুলতানি মাটি, কমলার রস- ইন্সট্যান্ট গ্লো আনার জন্য সবচেয়ে ভাল এই প্যাক। দুই চা চামচ মুলতানি মাটির সঙ্গে চার টেবিল চামচ কমলালেবুর রস মিশিয়ে নিন। এই প্যাক মুখে, গলায় ২০ মিনিট লাগিয়ে রেখে জল দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। শীতকালে ত্বকের জন্য এই প্যাক খুব ভাল। কমলালেবুর রস খুব ভাল অ্যান্টিঅক্সিড্যান্টের কাজ করে। ভিটামিন সি পরিপূর্ণ এই রস ট্যান পুরোপুরি দূর করে ত্বকের রঙ ফিরিয়ে আনে। ভিরত থেকে পুষ্টি জোগায়।

মুলতানি মাটি, আঙুর, মধু- মুখে বয়সের ছাপ পড়লে, বলিরেখা দেখা দিলে অবশ্যই এই প্যাক ব্যবহার করুন। কয়েকটা আঙুর চটকে নিয়ে এক টেবিল চামচ মুলতানি মাটি ও এক টেবিল চামচ মধু মিশিয়ে মুখে লাগিয়ে রাখুন ২০ মিনিট। ঠান্ডা জলে ধুয়ে ফেলুন। এই প্যাক পার্লারের মতো ফেসিয়াল গ্লো নিয়ে আসে চেহারা। আঙুর বয়স ধরে রাখতে সাহায্য করে। মধু ময়শ্চারাইজার হিসেবে ভাল কাজ করে।